আমার সি-সেকশনের অভিজ্ঞতা
একটা সরু সুঁচ আমার শিরদাঁড়া ভেদ করে শীতল ওষুধ ছড়িয়ে কোমরের নিচ অংশকে বোধহীন করে রেখেছে বেশ আগে থেকেই। দুই হাত দুই পাশে বেল্ট দিয়ে আটকানো। মাথার কাছে জামি কে একটা চেয়ার দিয়ে বসিয়ে রেখেছে। আবার একজন অ্যানেস্থেশিয়লজিস্ট ও একজন নার্স আমার মাথার অন্যপাশে দাঁড়ানো। একজন ভাইটাল চেক করছে সর্বক্ষন, আর একজন আমার ভালো লাগা/মন্দ লাগার খোঁজ নিচ্ছে, আবার মাঝে মাঝে এলোমেলো চুল গুলোকে গুঁছিয়ে ঠিক করে দিচ্ছে। আমার মুখটা আয়নায় দেখার সুযোগ নেই কিন্তু জামিকে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, কি ফ্যাকাসে একটা মুখ! দেখেই বুঝা যায়, সুযোগ পেলেই কষে এক দৌড় দিত। হাসপাতালে থাকার অভিজ্ঞতা যার শুন্য তাকে এনেই ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে অপারেশন থিয়েটারে!
আমার বুকের কাছে পর্দা দেয়া বলে কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা। শুধু একটা ঝাকুনি অনুভব করছি।মনে হচ্ছে আমি লোকাল বাসে মালিবাগ থেকে মগবাজার যাচ্ছি। এত বমি পাচ্ছে, এই নিয়ে ৩ বার বমি ও করা হয়ে গেছে। কেঊ একজন সাকশন করে সেগুলো সাথে সাথে ক্লিন করে ফেলছে। হঠাৎ মনে হল একটা হেচকা টান দিয়ে বুকের ভেতর থেকে কিছু একটা বের করে নিল। আমি ও ওও ওও শব্দ করতে করতে শুনি বাচ্চার কান্নার আওয়াজ। আলহামদুলিল্লাহ্ ! ইনায়ার কান্না শুনে আমি হাসছি না কাঁদছি সেটাও জানিনা। ওকে বের করেই সোজা জামির দিকে মুখ করে ধরেছে, সেটা দেখা মাত্র তার মুখের অবস্থা আরো করুন হয়ে গেলো। শেষ পর্যন্ত বলেই বসল “Can I have some water plz” অপারেশন থিয়েটারে পানি খাওয়ার ব্যাবস্থা থাকবেনা এটাই স্বাভাবিক তাই সবাই তাকে অনুমতি দিল লেবার রুমে যাওয়ার। ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি এমন ভাব করে সে দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে গেল। সবাই হাসতে হাসতে অন্য বাবা দের ওটির অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে লাগল।
বাচ্চার ওজন, উচ্চতা আরো কিছু ভাইটালস চেক করে আমার মুখের কাছে আনা হল। হাতের বাঁধন টা খুলে ওকে একটু ছুঁয়ে দেখতে মন অস্থির হয়ে উঠছিল। আমি ডাকলাম “মা ও মা! চিনতে পেরেছ আমাকে? আমার কণ্ঠ শুনে কেমন পিট পিট করে তাকিয়ে দেখছিল! ৩০ সেকেন্ডস এর মত রেখে ওকে পাঠিয়ে দিল NICU তে। আর আমাকে পাঠানো হল পোস্ট অপারেটিভ রুমে। আমি বার বার ইনায়া কে দেখতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু ওরা জানাল বাচ্চার ইনফেকশন এর কারনে জ্বর হচ্ছে ওর ট্রিটমেন্ট চলবে NICU তে। বাবা যেকোন সময় গিয়ে দেখে আসতে পারবে কিন্তু আমার জন্য কয়েক ঘন্টা রেস্ট নেয়া বাধ্যতামূলক।
৯ ঘণ্টা পর প্রথম বুকের দুধ পাঠানো হল, আর নার্স আমাকে জানালো, যদি মেয়েকে জলদি দেখতে চাও তাহলে হাঁটার চেষ্টা কর।এরপর ১২ ঘণ্টার মাথায় আমাকে প্রথম হাঁটানো হল। প্রথম কয়েকটা ধাপ ফেলা মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সবথেকে কঠিন কাজ। অনেক কান্নাকাটি করলে ও আমাকে বিন্দু মাত্র ছাড় দেয়া হয়নি। পরদিন সকালে যাব তাই নার্স আসার আগেই আমি আরও ২ বার নিজে নিজেই হেঁটেছি। সকাল সাড়ে নটায় খুব এক্সাইটমেণ্ট নিয়ে বের হলাম। একজন স্বাভাবিক মানুষের জন্য NICU তে যেতে লাগবে ৩ থেকে ৪ মিনিট। অথচ আমি সময় নিয়েছিলাম ১৫ মিনিট এর ও বেশি। প্রতিটি স্টেপ এ মনে হচ্ছিল সেলাই এর জায়গা তে কেঊ আগুন জালিয়ে দিয়েছে। সাথে পা দুটো ছিল অনেক বেশি ফোলা আর ভারী! তবুও মেয়েকে প্রথম বারের মত কোলে নিতে পারব এই আশায় সব ভুলে সামনে আগানো। পেডিয়াট্রিশিয়ান ডাঃ নিক্স বললেন, অ্যান্টিবায়োটিক ট্রিটমেন্ট চলছে তাই ওকে 5 দিন থাকতে হবে ওখানেই, আমাকে রিলিজ করে দেয়া হবে 3 দিনের মাথায়। বাচ্চাকে প্রতি 2/3 ঘন্টা পর পর ফিডিং করাতে হবে তাই পাম্প করে অথবা সশরীরে আমাকে আসতে হবে। আমি নিজেই আসব বলে মনস্থির করলাম।
এত সহজ না যতটা ভেবেছি তা বুঝলাম পোস্ট অপারেটিভ রুমে গিয়েই। অসহ্য ব্যাথা আর জালাপোড়া আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। হাই ডোজ ব্যাথার ওষুধ দেয়া হল। একটু উপশম পাওয়ার আগেই আবারো ফিডিং টাইম হয়ে আসল। আমি আবারো হাঁটছি। চোখ দিয়ে ফোটা ফোটা পানি পড়ছে কিন্তু আমি জানি মেয়েটা ক্ষুধায় কাঁদছে। এবার রুমে ফিরে নার্স কে রিকোয়েস্ট করলাম একটা হুইল চেয়ার এর জন্য, কিন্তু সেটা রিফিউজ করা হল। ওই দিন কোন রকম পার করে পরের দিন আমি অনেক জিদ করে বলেছিলাম,” হুইল চেয়ার আমার লাগবেই।” সেটা পারমিট করেছিল একটা নার্স কিন্তু শর্ত ছিল, বসে নয় হুইল চেয়ার ধরে ধরে হেঁটেই যেতে হবে। আজিব দেশ আজিব নিয়ম! রাগে ফেটে পড়ছিলাম আমি কিন্তু সামনাসামনি ছিলাম শান্ত।প্রতিটি নার্স বেশ জোর দিয়েই বারবার বলছিল, “হাঁটলে ব্লাড সার্কুলেশন ভালোভাবে হবে তাই যত বেশি হাঁটতে পারবে তত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।” জামি ও বেশ শক্ত ছিল এই ব্যাপারে। হুইল চেয়ারে বসে যাই এটা সেও চায়নি। রাগ হয়েছিল খুব, বলেছিলাম “ তোমার একটু ও মায়া নাই” এদিকে পেডিয়াট্রিশিয়ান ডাঃ নিক্স একটা কনসেন্ট পেপার দিয়ে বললেন, “ তোমার যেহেতু আসতে কষ্ট হয় আবার মাঝে মাঝে দেরী করে ফেল তাই অকেশনালি ফরমুলা খাওয়ানোর ব্যাপারে আমাদের অনুমতি দাও।” আমি টাইমলি আশার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফরমুলা না খাওয়ানোর অনুরোধ করলাম। চ্যালেঞ্জ যেন বেড়েই যাচ্ছিল, যদি ও হাঁটার কষ্টটা কিছুটা কমে গেছে কিন্তু মেয়ে আমার আড়াই ঘণ্টা পর পর ক্ষুধায় কাঁদতে থাকে তাই বারবার NICU তে যাওয়ার ফ্রিকোয়েন্সি বেড়েছে।
তৃতীয় দিন ডাঃ নিক্স আমার উপর রীতিমত ক্ষেপে গিয়ে বলল “ We cant take it anymore! plz give us your consent। তখনো আমার ফ্লো তেমন ভালো ছিলনা তাই আমি বাধ্য হয়ে সাইন করি। পরে ল্যাক্টেশন স্পেশালিষ্ট আমার রুমে এসে বললেন, “ তুমি কি অনেক প্রেশার নিচ্ছ? তুমি ব্রেস্টফিড করাতে চাও এটা খুব ভালো, We realy appreciate it.কিন্তু তোমাকে স্ট্রেস ফ্রি হতে হবে এবং প্রচুর ফ্লুয়িড খেতে হবে, সাথে বারবার পাম্প করতে হবে। বুকের দুধ আসাটা একটা প্রাকৃতিক নিয়ম। কিছু নিয়ম ফলো না করলে সেটা অনেক সময় ডিলেই করতে পারে।“ উনার কথাগুলো আমি বর্ণে বর্ণে ফলো করেছিলাম। দুপুর অব্দী ইনায়াকে ২ বার ফরমুলা দেয়া হয়। এরপর আল্লাহ্র অশেষ রহমতে আমার পারফেক্ট ফ্লো আসে। পাম্প করে ৩ বার খেতে পারবে এই পরিমাণ মিল্ক পাঠিয়ে দেই । এরপর আর ওকে ফরমুলা খাওয়াতরে হয় নি। যেদিন আমাদের রিলিজ দিয়ে ইনায়াকে রেখে দেয়ার কথা সেদিন আমরা দুজন খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম।খালি হাতে বাসায় ফেরার কথা তো ছিলনা!
এদিকে ডাঃ নিক্স ইনায়ার ফাইনাল কিছু টেস্ট করেন আর আমাদের কে বলেন সকালে না গিয়ে বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। দুপুরেই জানতে পারলাম ওর ইনফেকশন/ জ্বর ভালো হয়ে গেছে। সুগার লেভেল একটু বাড়তি ছিল সেটা নরমাল ভ্যালু তে এসেছে। জন্ডিস সাস্পেক্ট করেছিল সেটা নেগেটিভ এসেছে। বাচ্চা জন্মের পর যে ওয়েট লুজ করেছিল সেটা বাড়তে শুরু করেছে।
ফলাফলঃ ইনায়া আমাদের সাথে বাসায় যেতে পারবে। এটা শোনার পর মনে হয়েছিল ৫ দিনের যুদ্ধে আমরা জয়ী। সন্তান পৃথিবীতে এসেছে এই খুশি যেন এখন এসে অনুভব করতে পারছি। বাসায় ফিরেই নিজে রান্না করে খেতে পেরেছিলাম, ইভেন এখন পর্যন্ত আমি যতট অ্যাক্টিভ সেটা দেখে অনেকেই কনফিউজড হয়ে যায় যে, আমার কি আসলেই সিজার হয়েছিল কি না? । আলহামদুলিল্লাহ্। আমার অভিজ্ঞতা থেকে ২ টি বিষয়ের উপর জোর দেয়া হয়েছে।
১। সিজার পরবর্তী হাঁটাচলা
২। আর্লি রেস্টফিডিং এর গুরুত্ব
অধিকাংশ নতুন মায়েরা সি সেকশন এর পর নিজে নিজে গোসল ও দিতে ভয় পায়। ব্যাথার কারণে স্টেপ ফেলতে চায়না। আমি সবার ফিলিংস কে রেস্পেক্ট করি, কিন্তু লং টাইম ভালো থাকার জন্য কিছুটা কষ্ট আমাদের করতেই হয় মা! আর ব্রেস্ট মিল্ক নিয়ে হতাশা নরমাল ফ্লো কে ব্যাহত করে। তাই চেষ্টা করুন টেনশন ফ্রি থেকে প্রচুর পরিমাণ পানি এবং রিয়েল ফ্রুট জুস খেতে। আল্লাহ্ সব মায়ের কষ্ট গুলো কে কবুল করে নিন।
রাবেয়া সুলতানা
হেলথ প্রফেশনাল এবং নতুন মা।
Disclaimer: এই ইনফরমেশন গুলোর উদ্দেশ্য হলো স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানো। তবে কোনো ভাবেই চিকিৎসার বিকল্প নয়। জানুন বুঝুন এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিন। আমাদের লেখায় যদি কোনো তথ্যগত ভুল বা বিভ্রান্তি থাকে তাহলে আমাদের ইনফর্ম করে ইম্প্রোভ করার সুযোগ করে দিন। যোগাযোগ: [email protected]
Share your comment :