গর্ভবস্থায় কনস্টিপেশন বা শক্ত পায়খানা
গর্ভবস্থায় কনস্টিপেশন বা শক্ত পায়খানা হওয়ার অভিযোগ কম বেশি সকল গর্ভবতী মায়েরা দিয়ে থাকেন। এমনিতেই তারা এই সময় নানা ধরনের সমস্যায় থাকেন। কিন্তু পায়খানা ক্লিয়ার না হওয়ায় তাদের বিদ্যমান সমস্যাগুলো আরো তীব্রতর হয়। ফলে সবসময় একটা অস্বস্বিকর ভাব কাজ করে যার প্রভাব পরে মন ও শরীরের উপর। সম্প্রতি এমন একজন গর্ভবতী মাকে আমার সেবা দেয়ার সুযোগ হয়েছিল।
কিছুদিন আগে একজন ৩২ সপ্তাহের গর্ভবতী মা আমাদের উপজেলা হাসপাতলে প্রথমবারের মতন চেকআপ করাতে আসেন। উনাকে দেখে বেশ চিন্তিত মনে হলো। আবার চোখেও যেন পানি টলমল করছে। কথা বলার এক পর্যায়ে বুঝলাম তিনি প্রেগন্যান্সির প্রায় শুরু থেকেই কনস্টিপেশনে ভুগছেন। এখন অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে হাসপাতালে না এসে পারলেননা। যেই বিষয়টি আমাকে অবাক করেছে তা হলো উনি হাসপাতালে চেকআপ করাতে আসেননি শুধু ঔষধ খাবার ভয়ে। ঔষধ খেলে নাকি ওনার বাচ্চা বড় হয়ে যাবে। আর বাচ্চা বড় হলে তিনি নরমাল ডেলিভারি করাতে পারবেননা। এমনকি উনি প্রেগ্ন্যাসিতে কোনো পুষ্টিকর খাবার বা শাক সব্জি /আশযুক্ত খাবারও তেমন খেতেননা। উপরোক্ত তথ্য পাওয়ার পর আমার আর বুঝতে বাকি রইলোনা ওনার কনস্টিপেশনের কারণ কি।
অবশেষে সব রুটিন চেকআপ শেষ করে আমি এবং আমাদের গাইনিকলোজিস্ট তাকে প্রায় ৪০মিনিট ধরে কাউন্সিলিং করি। যাতে তিনি তার ভুল ধারনা/কুসংস্কার থেকে বের হয়ে আসতে পারেন। যাতে অন্য মায়েরাও এমন সমস্যা না পরেন বা এমন সমস্যা থাকলেও যেন তারা নিউজেরাই নিজেদের যত্ন নিতে পারেন তাদের জন্য এই লিখাটি।
কনস্টিপেশন বা কোষ্ঠকাঠিণ্য কি ?
আমরা প্রতিনিয়ত যে খাবার খাই তা আমাদের শরীরে প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান দেয়। কিন্তু এই খাদ্যের অপ্রয়োজনীয় অংশ মল রুপে আমাদের দেহ থেকে বের হয়ে যায়। তবে এই মল যদি নিয়মিত বের না হয় অথবা ঠিকমতো বের না হয় তখন পেটে গ্যাস জমা হয়। একটা সময় মল সহজে বের হয়না এবং শক্ত হয়ে যায়। যাকে আমরা কনস্টিপেশন(কোষ্ঠকাঠিণ্য) বলে থাকি। বয়স্ক এবং গর্ভবতী মহিলারা কোষ্টকাঠিণ্যের স্বীকার বেশি হন।
গর্ভবস্থায় কনস্টিপেশন যে সব কারণে হয়
- হরমোনঃ গর্ভবস্থায় প্রজোস্টরন হরমোন এর মাত্রা বেড়ে যায় ফলে মায়েদের শরীরের সমস্ত পেশী গুলি শিথীল হয়ে পড়ে, যেহেতু পরিপাকতন্ত্রের পেশী গুলি ও শিথিল হয়ে পড়ে ফলে মায়েদের খাবার হজম ধীরে গতিতে হয় এবং কনস্টিপেশান দেখা দেয়।
- পানিঃ একজন সুস্থ্য স্বাভাবিক মানুষ দৈনিক ২.৫ থেকে ৩লিটার পানি পান করা প্রয়োজন।গর্ভবস্থায় মা একা নন তার সাথে আর এক জন আছে ফলে তার শরীরে পানির প্রয়োজীয়তা বেড়ে যায় কিন্তু সেই পরিমান পানি পান করা হয় না ফলে কনস্টিপেশন দেখা যায়।
- ওজনঃ গর্ভবস্থায় ওজন ও আয়তনে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জরায়ু বৃহদতন্ত্রের ও মলাশয়ের উপর চাপ প্রয়োগ করে চাপ সৃষ্টির কারনে কনস্টিপেশন হতে পারে।
- খাদ্যঃ উচ্চ চর্বিযুক্ত/তৈলাক্ত খাবার, অতিরিক্ত মশলা জাতীয় খাবার, ফাস্টফুড জাতীয় খাবার গ্রহন এবং প্রয়োজনীয় আশ যুক্ত খাবার বা পর্যাপ্ত শাকসব্জি না খাওয়ায় কনস্টিপেশন হতে পারে।
- টেনশন: দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপের কারনেও হতে পারে।
গর্ভবস্থায় আয়রন সাপ্লিমেন্ট সবাই নিয়ে থাকি কিন্তু সেই সাথে পুষ্টিকর খাবার খাইনা, আয়রন টেবলেট এর জন্যও কনস্টিপেশান হতে পারে। এ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা ইত্যাদি কারনেও হতে পারে আরও বিভিন্ন কারন থাকতে পারে।
কনস্টিপেশন হলে কিভাবে বুঝবেন বা লক্ষন কি কি?
- অনিয়মিত মল ত্যাগ, মল ত্যাগের সময় প্রচুর চাপ প্রয়োগ বা কঠিন মল/পায়খানা।
- পেট ফুলে যেতে পারে বা পেট ব্যাথা হতে পারে (যা পায়খানা/মল ত্যাগ করলে ব্যাথা কমে যায়)
- ক্ষুধামন্দা
- শক্ত বা ছোট ছোট যা বের করা অনেক কষ্টকর ফলে পায়ুপথ জ্বালা করতে পারে
- মলের সঙ্গে রক্ত যাওয়া (হেমোরেয়েড বা ফিশার এর কারনে)
- বমি হতে পারে
কনস্টিপেশন থেকে বাচার উপায় বা প্রতিকার
এটা থেকে মুক্তি পেতে প্রচুর পানি ও শরবত পান করুন পানির কোনো বিকল্প নাই।আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় শরীরে যতেষ্ট পানি না পাওয়ার কারনেই তৈরি হয় কনস্টিপেশন সহ বিভিন্ন সমস্যা। তাই বেশি বেশি পানি পান করুন হাইড্রেট থাকুন, সুস্থ থাকুন।
আঁশযুক্ত খাবার: আমেরিকান স্বাস্থ্য পোর্টাল ওয়েব এমডির মতে, একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মহিলার যার বয়স ৫১ নিচে তাকে প্রতিদিন কমপক্ষে ২৫ গ্রাম আঁশ যুক্ত খাবার খাওয়া উচিত। যা একজন মায়ের শরীরকে সুস্থ রাখতে বিশেষ করে কনস্টিপেশন থেকে বাঁচতে সহায়তা করে।
শাকসবজি, ফলমূল কনস্টিপেশন বা কোষ্ঠকাঠিন্যের শত্রু। আঁশযুক্ত খাবার খেলে মল বাড়ে। কোষ্ঠকাঠিন্যও দূর হয়। চিকিৎসকরা বলেন, গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্য কমানোর প্রথম ধাপ হল বেশি করে আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া। যদি আপনি নিয়মিত লালশাক,পালংশাক, লাউশাক, গাজর, আলু, আঙুর, আপেল, কমলা, বেদানা, কলা,লাল চাল, শুকনো ফল,চিনাবাদাম, কাঠবাদাম, তিসি, খেজুর, এবং কিশমিশ খান তাহলে গর্ভাবস্থায় কনস্টিপেশনের টেনশন থাকার কথা নয়।
হালকা ব্যায়াম: যারা নিয়মিত ব্যায়াম করেন, তাদের কোষ্ঠকাঠিন্য, পাইলস, ফিস্টুলা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। অন্তঃসত্ত্বাদেরও কিছু হালকা ব্যায়াম আছে (যাদের অন্য কোনো জটিলতা নেই) তারা এগুলো অনুসরণ করলে এ সমস্যা কেটে যাবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে গর্ভবস্থায় সব ধরনের ব্যায়াম সবার জন্য নিরাপদ না তাই এক্ষেত্রে ডাক্তার/মিডওয়াইফের পরামর্শ নেওয়া অত্যাবশক।
দানাদার খাবার: বাদামসহ বিচিজাতীয় খাবারে প্রচুর পরিমাণে আঁশ পাওয়া যায়। কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে খাদ্যতালিকায় এই খাবারগুলো রাখতে পারেন। দানাদার খাবার খাওয়ার পরামর্শ চিকিৎসকরাও দিয়ে থাকেন। এটি সন্তানের পুষ্টি জোগায়।
ইসবগুল: এটা আমাদের গ্রাম গুলিতে সবারি পরিচিত।কোষ্ঠকাঠিন্যের সঙ্গে ইসবগুলোর সম্পর্ক সাপে নেউলে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় যারা এ সমস্যায় ভোগেন, তারা ইসবগুল খেতে পারেন তবে ডাক্তার/মিডওয়াইওফের পরামর্শ নিয়ে।
লেবু পানি: লেবু পানি কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে আরেকটি চমৎকার উপায়। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় লেবু পানি গ্যাসের সমস্যা সৃষ্টি করে। লেবুর মধ্যে রয়েছে ভিটামিন-সি। এটি শিশুর বৃদ্ধিতেও কাজ করে।
কনস্টিপেশনের কারনে সাধারণত গর্ভাবস্থায় তেমন কোনো সমস্যা হয়না দু একবার হতেই পারে কিন্তু যদি ক্রমাগত দু সপ্তাহ কিংবা তার ওবেশি সময় ধরে ভুগতে হয় তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
এটা অন্য সমস্যার লক্ষন হতে পারে যদি এর সাথে জ্বর,তলপেটে ব্যথা,মল হালকা বা মলের সাথে রক্ত বা মিউকাস যায় তবে দ্রুত ডাক্তারের এর শরানাপন্ন হতে হবে।
আসুন সবাই মিলে নিয়ম মেনে চলি, সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরি
পারুল আক্তার
মিডওয়াইফ
Disclaimer: এই ইনফরমেশন গুলোর উদ্দেশ্য হলো স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানো। তবে কোনো ভাবেই চিকিৎসার বিকল্প নয়। জানুন বুঝুন এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিন। আমাদের লেখায় যদি কোনো তথ্যগত ভুল বা বিভ্রান্তি থাকে তাহলে আমাদের ইনফর্ম করে ইম্প্রোভ করার সুযোগ করে দিন। যোগাযোগ: [email protected]
Share your comment :