ব্রেস্টফিডিং এর খুঁটিনাটি
“আমার তো বুকের দুধ তেমন আসেনি তাই বাচ্চাকে ফর্মুলা দিয়েছি।“
“শুনেছি বুকের দুধের পাশাপাশি ফর্মুলা দিলে বাচ্চার স্বাস্থ্য ভালো হয়, তাই আমরা ও ফর্মুলা দিচ্ছি।“
“আমার নিপল ভিতরে ঢুকানো বাচ্চা চুষতে পারেনা তাই ফর্মুলা দিচ্ছি।“
কথা গুলো কি পরিচিত লাগছে না?
নতুন মা দের কাছ থেকে আমরা এমন কথাগুলো আমরা প্রায় প্রতিনিয়ত শুনি। কিন্তু আসলেই কি কথা গুলো যুক্তিযুক্ত?
যেখানে চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, একজন নতুন মা এর বুকে দুধ আসা পৃথিবীর অন্যতম চমৎকার এবং স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। একটি কন্যা সন্তান যখন ভ্রূণ অবস্থায় মায়ের গর্ভে থাকে তখন থেকেই তার ব্রেস্ট এর গঠন প্রণালী শুরু হয়। অর্থাৎ ব্রেস্ট কে যদি একটি গাছের সাথে তুলনা করা হয় তাহলে তার শিকড় গুলো প্রথম স্থাপিত হয় জন্মগ্রহণ করার সাথে সাথে। পিরিয়ড/বয়ঃসন্ধি কাল এর আগে পর্যন্ত এটি অনেকটা স্থির অবস্থায় থাকে কিন্তু এর পর পর ই শরীরে ইস্ট্রোজেন নামক হরমোনের এক প্রকার বন্যা প্রবাহিত হয় যা ব্রেস্ট এর বৃদ্ধি এবং ফুলে উঠার জন্য সহায়ক। গর্ভাবস্থায় এর মাত্রা আরও বেড়ে যায় কিন্তু ব্রেস্ট এর পরিপূর্ণতা আসে শুধুমাত্র সন্তান জন্মের পর।
সুতরাং, বুকের দুধ আসাটাই স্বাভাবিক। যদি কম আসে/না আসে তাহলে সেটা নিয়ম ফলো করার গ্যাপ এর কারনে হতে পারে।
আজকের আর্টিকেল টি তে যা থাকছে:
- ব্রেস্টমিল্ক নাকি ফর্মুলা, কোনটা আসলে ভাল?
- কতদিন পর থেকে ঠিকমত ফ্লো আসবে?
- অতিরিক্ত ব্রেস্টমিল্ক কিভাবে সংরক্ষন করব?
- বাচ্চা পর্যাপ্ত দুধ পাচ্ছে কি না কিভাবে বুঝব?
- ব্রেস্টফিডিং এর “অ আ ক খ”
- যাদের নিপল ফেটে যায় তারাও কি ব্রেস্টফিড করবে?
ভেবে দেখেছেন কি,ব্রেস্টফিডিং এর উপর কেন এত জোর দেয়া হয়?
প্রতিবার যখন আপনি বাচ্চাকে ব্রেস্টফিড করান তখন আপনার শরীরের অ্যান্টবডি গুলো তার শরীরে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের অসুখ যেমন কানের ইনফেকশন, ফুসফুসের ইনফেকশন আর কিছু কমন রোগবালাই থেকে বাচ্চাকে রক্ষা করে। তাই ব্রেস্টমিল্ক কে ন্যাচারাল অ্যান্টিবায়োটিক বলা হয়ে থাকে। এই দুধ বাচ্চার পাকস্থলীর জন্য স্পেশালি তৈরি বলে হজম হয় খুব সহজে যেটা ফর্মুলার ক্ষেত্রে হয় না। ব্রেস্ট ফেড বাচ্চারা সাধারণত ওভার ওয়েট না হয়ে স্বাস্থ্যসম্মত ওজনের অধিকারী হয়।
সেইসাথে, যেসব মা নিয়মিত ব্রেস্ট ফিড করান তাদের প্রেগন্যন্সি পরবর্তি বাড়তি ওজন, ডায়াবেটিস, অস্টিওপরেসিস এবং ওভারিয়ান ক্যন্সার এর মত মারাত্মক রোগের ঝুঁকি কমে যায়।
আবার, বাচ্চাকে খাওয়ানোর জন্য ফর্মুলা রেডি করতে যে সময় এবং অর্থের প্রয়োজন হয় সেই সময় টুকু ব্রেস্টফিড করালে একইসাথে বাচ্চাকে বেশি সময় দেয়া এবং বন্ডিং তৈরি করা সম্ভব, আর ফাইন্যান্সিয়াল বেনেফিট তো আছেই।
কতদিন পর থেকে ঠিকমত ফ্লো আসবে এই চিন্তা যেন সব মায়ের।
বিষেশজ্ঞ দের মতে, মায়ের বুক থেকে প্রথম যে হলুদাভ রং এর ঘন টাইপ এর অল্প পরিমান যে দুধ প্রোডাকশন হয় তাকে কোলস্ট্রাম বলে। বাচ্চা জন্মের পর প্রথম ২-৩দিন ১-২চামচ পরিমান দুধ আসে এবং বাচ্চার জন্য ততটুকু ই ওই সময় যথেস্ট হয়। দুধ আসার এই সময় টা কে প্রথম ধাপ বলা হয়। সময়ের সাথে সাথে বাচ্চার চাহিদা অনুযায়ী দুধ আসার পরিমান বাড়তে থাকে। ৩-৪দিন থেকে শুরু হয় পরের ধাপ অর্থাৎ ট্রানজিশন ফেইজ। এখানে দুধের পরিমান আগের চেয়ে কিছুটা বাড়ে। কিন্তু শেষ ধাপ, যেটাকে বলে ম্যাচিউর ফেইজ শুরু হয় ১০-১৫দিনে, সেখানে একজন মা এর প্রচুর পরিমান দুধ প্রডিউস হওয়া শুরু হয়ে যায়।একজন সুস্থ্য সাভাবিক মা এই পর্যায় থেকে ৩ জন বাচ্চার সমপরিমান দুধ প্রোডাকশন করতে পারে। তবে এই সময় মা দের ডায়েট এর প্রতি সর্বচ্চো গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। এটা খেতে হবে ওটা খেতে হবে এই ধাঁধার মধ্যে না পড়া চেষ্টা করুন প্রচুর পরিমাণে পানি, জুস/লিকুইড জাতীয় খাবার এবং প্রোটিন জাতীয় খাবার খেতে। কেননা, দুধ বাড়াতে পানির ভূমিকা সবার উপরে। অনেকের মতে লাউ এর তরকারি, কালিজিরা, শিং মাছের ঝোল এগুলো দুধ বাড়ানো তে সহায়ক। সরাসরি ভাবে গবেষণা না থাকলে ও এই খাবার গুলোর উপকারিতা বিভিন্ন ভাবে প্রমাণিত।
এখন প্রশ্ন আসে যে, এত বেশি প্রোডাকশন হওয়া দুধ গুলো কিভাবে সংরক্ষন করা যায়?
খুব সহজ! জাস্ট পরিস্কার এয়ার টাইট কন্টেইনার এ পাম্প করা দুধ ফ্রিজার এর নরমাল চেম্বারে ৪ দিন এবং ডিপ চেম্বারে ৬ মাস থেকে 1 বছর পর্যন্ত সংগ্রহ করা যায়। দুধ প্রোডাকশন হলেও বাচ্চা পর্যাপ্ত দুধ টানতে পারছে কিনা এটা অনেক মায়ের চিন্তার কারন হয়ে দ্বারায়।
এই ক্ষেত্রে চিকিৎসক রা বলে থাকেন, বাচ্চা জন্মের পর ৩/৪ দিনের মধ্যে সাভাবিক ভাবেই ৭% পরিমান ওজন হ্রাস করে। খেয়াল রাখতে হবে এর চেয়ে বেশি পরিমান ওজন কমে যাচ্ছে কিনা। খাওয়ানোর পরে 1-৩ ঘন্টার মধ্যে সে খাবার জন্য কাঁদতে থাকে কিনা? দিনে কমপক্ষে ৬ টা ডায়পার চেঞ্জ করতে হয় কিনা?
ব্রেস্টফিডিং নিয়ে অনেক কিছু জানা হয়ে গেছে এর মধ্যেই। আসুন এবার ৩ টি বেসিক বিষয় শিখে নেই।
ব্রেস্টফিডিং এর “অ আ ক খ”
লক্ষ করুন:
আপনার বাচ্চার ক্ষুধার সাইন গুলো কি আপনি জানেন? খেয়াল করুন, সে খুব বেশি বেশি মুখে হাত দিচ্ছে কিনা? মুখ দিয়ে চোষার আওয়াজ করছে কিনা? আপনার বুকের কাছে বার বার মুখ এগিয়ে দিচ্ছে কিনা? বার বার মাথা ডানে বামে ঘুরাচ্ছে কিনা? এগুলো কে বলে “হাংগার সাইন”! আর এগুলো দেখে যখন আপনি বাচ্চাকে খাওয়াবেন তখন সেটাকে বলে অন ডিমান্ড ফিডিং। জন্মের পর প্রথম কয়েক সপ্তাহ ২৪ ঘন্টায় একটি নবজাতক ৮-১২ বার পর্যন্ত ব্রেস্টফিড করে। তবে বাচ্চা ক্ষুধার্ত কিনা সেই সাইন না দেখে তার সময় বুঝে কান্না করার আগেই খাওয়ানো উচিৎ।
ধৈর্য রাখুন:
নবজাতক কে ব্রেস্টফিডিং করানোর সময় তারাহুড়া না করা। সাভাবিক অবস্থায় বাচ্চা ১০-২০মিনিট পর্যন্ত একপাশের দুধ টানতে পারে।
রিল্যাক্স থাকুন:
অস্থিরতা আর টেনশন নিয়ে ব্রেস্টফিড করালে দুধের স্বাভাবিক ফ্লো আসতে বাধাগ্রস্থ্য হয়। তাই স্থির হোন, দুধ আসবে কি আসবে না এই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। প্রয়োজন মত বালিশ ব্যাবহার করে নিজের বসা বা আধাশোয়া পজিশন কে আগে থেকে কমফোর্টেবল করে নিন। বাজারে কিছু নার্সিং পিলো কিনতে পাওয়া যায় চাইলে সেটা ও ব্যবহার করতে পারেন।
কিছু ক্ষেত্রে ব্রেস্ট ফিডিং করানো একধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়ায়। যেমন:
ফোঁড়া যুক্ত নিপল থাকলে
শুকিয়ে নিপল ফেটে গেলে
দুধ জমে গিয়ে গোটা তৈরি হলে (ব্রেস্ট এনগর্গমেন্ট)
ব্রেস্ট ইনফেকশন থাকলে
ব্রেস্টের নালি ব্লক হয়ে গেলে
তবে এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসক এর পরামর্ষ অনুযায়ী কিছু অয়েন্টমেন্ট/মেডিসিন ব্যাবহার /নিয়ম ফলো করলে এই সমস্যা গুলোর সহজ সমাধান পাওয়া সম্ভব।
সবশেষে, প্রতিটি নবজাতক ই কান্না করা এবং দুধ চুষার ক্ষমতা এই দুটি শিখেই জন্ম নেয়। তাই জন্মের পর পর বাচ্চাকে মায়ের বুকে নিলে সে নিজে থেকেই চুষতে চাইবে এবং এর সাথে কিছুটা সাহায্য করলেই সে আসল নিপল এর সাথে পরিচিত হয়ে যাবে কিন্তু যদি প্রথম দিকেই বাইরের নিপল দিয়ে ফর্মুলা ইন্ট্রোডিউস করানো হয় তাহলে বাচ্চার নিপল কনফিউশন হয়ে যেতে পারে এবং ব্রেস্টফিডিং এ অনীহা প্রকাশ করতে ও পারে।
মনে রাখা জরুরি, প্রথম ৩/৪দিনের মধ্যে বাচ্চার যে ওজন কমে যায় সেটা সাভাবিক প্রক্রিয়া, সেটাকে বুকের দুধ পাওয়া/না পাওয়া সম্পৃক্ত নয়।
Disclaimer: এই ইনফরমেশন গুলোর উদ্দেশ্য হলো স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানো। তবে কোনো ভাবেই চিকিৎসার বিকল্প নয়। জানুন বুঝুন এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিন। আমাদের লেখায় যদি কোনো তথ্যগত ভুল বা বিভ্রান্তি থাকে তাহলে আমাদের ইনফর্ম করে ইম্প্রোভ করার সুযোগ করে দিন। যোগাযোগ: [email protected]
Share your comment :